মুতা হল এক ধরণের সাময়িক বা অস্থায়ী বিবাহ, অথবা বলা ভাল বিশেষ উদ্দেশ্যে করা একটি যৌনচুক্তি, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু অর্থের বিনিময়ে হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময় সীমা অতিক্রম হওয়ার সাথে সাথে আপনা হতে এ বিবাহ চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যায়। এর জন্য আলাদাভাবে তালাকের দরকার হয় না। মুতা বিবাহ (Arabic: نكاح المتعة, nikāḥ al-mutʿah, আক্ষরিক অর্থে ভোগের বিবাহ বা pleasure marriage) নামক এই প্রথাটিকে আরব অঞ্চলে মুহাম্মদের যুগে প্রচলিত হালাল যৌনচুক্তি বা পতিতাবৃত্তি বললেও ভুল হবে না।
কারণ, পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞাও একই। পতিতাবৃত্তি হচ্ছে এমন একটি পেশা, যেই পেশায় নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দুইজন মানুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কের একটি চুক্তি হয়, সেই সময়টি এবং কাজটি শেষ হলে তাদের চুক্তিটি বাতিল বলে গণ্য হয়। দুইজনার প্রতি দুইজনার আর কোন দায়দায়িত্ব থাকে না। এক্ষেত্রে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কোন উত্তরাধিকার লাভ করে না, স্ত্রী মারা গেলেও স্বামী কোন সম্পত্তি পায় না। শুধুমাত্র যৌনকাজের জন্য একপক্ষ অর্থ দেয়, আরেক পক্ষ অর্থ গ্রহণ করে।
মুহাম্মদের সাহাবীগণও কিছু অর্থের বিনিময়ে একরাত বা এক সপ্তাহের জন্য নারীদের যৌনকর্মের জন্য ভাড়া নিতো, যাকে সত্যিকার অর্থে পতিতাবৃত্তিই বলতে হয়। সুন্নী ইসলামের একটি বড় অংশ মনে করে, সেই সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর আকীদা হচ্ছে, ইসলাম একে প্রাথমিক সময়ে হালাল ঘোষণা করলেও, পরবর্তী সময়ে হারাম ঘোষণা করে। তবে, বেশিরভাগ অংশ একে নিষিদ্ধ মনে করলেও কিছু কিছু মুসলিম স্কলার মুতা বিবাহকে বৈধ মনে করেছেন।
তাফসীর আল কাবীরের লেখক ফখর আদ-দীন আর-রাযী বা ফখরুদ্দীন আল রাযি তার তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বেশিরভাগ সুন্নী আলেমই মুতা বিবাহকে অবৈধ মনে করলেও কিছু সুন্নী আলেম মুতাকে এখনো বৈধ মনে করেন। সেই সাথে, সুন্নী আলেমগণ মিসইয়ার নিকাহ এবং উর্ফি নিকাহকেও অনেক সময় বৈধতা দিয়েছেন, যেগুলো আসলে মুতা বিবাহের মতই। অনেকটা পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত লিভিং টুগেদারের মত এক ধরণের যৌনচুক্তি। সেই নিয়ে ভিন্ন সময়ে আলোচনা করা যাবে।
শিয়া মুসলিমদের মধ্যে বড় অংশ মনে করে, এটি সর্বসময়ের জন্য হালাল, যেহেতু খোদ নবী নিজেই এবং সাহাবীগণও কাজটি করেছেন। পরবর্তীতে হযরত উমর ফতোয়ার মাধ্যমে মুতা বিবাহ হারাম ঘোষণা করেন, যা ইসনা আশারিয়া বা বারো ইমামের অনুসারী শিয়ারা মানে না। ইরান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ইসনা আশারিয়া শিয়া ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। তবে, শিয়া মুসলিমদের মধ্যে একাংশও আবার মুতা বিবাহকে নিষিদ্ধ বলে মনে করেন। জায়েদি হল শিয়া ইসলামের একটি শাখা যা ধর্মতাত্ত্বিক দিক দিয়ে ইবাদি ও মুতাজিলা চিন্তাধারার এবং ফিকহশাস্ত্রীয় ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাবের নিকটবর্তী।
অষ্টম শতাব্দীতে শিয়া চিন্তাধারা থেকে জায়েদি মতবাদ উৎপত্তি লাভ করে। তৃতীয় ইমাম হোসাইন ইবনে আলীর দৌহিত্র এবং চতুর্থ ইমাম আলী ইবনে হোসাইনের পুত্র জায়েদ ইবনে আলীর নামানুসারে জায়েদিদের নামকরণ করা হয়। জায়েদি মাজহাবের অনুসারীদের জায়েদি শিয়া নামে অবিহিত করা হয়। জায়েদিরা ইয়েমেনের মোট মুসলিম জনসংখ্যার ৫০% যা দেশটির বৃহত্তম শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়৷ জায়েদি শিয়ারা বেশিরভাগ সুন্নীর মতই মুতা বিবাহকে অবৈধ মনে করেন।
অর্থাৎ সুন্নী মুসলিমদের মধ্যে বৃহৎ অংশ মুতাকে হারাম মনে করে, শিয়া মুসলিমদের মধ্যে একটি ছোট অংশও সেটিকে হারাম মানে। অন্যদিকে সুন্নীদের মধ্যে ছোট একটি অংশ একে হালাল মনে করে, আর শিয়াদের মধ্যে বড় একটি অংশ একে হালাল মনে করে। আমাদের আজকের আলোচনা হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ নিজে, তার সাহাবীগণ, কখন এবং কোন সময়ে এই সাময়িক বিবাহ বা হালাল বেশ্যাবৃত্তির বা ইসলামিক পরিভাষায় মুতা বিবাহ করেছিলেন কিনা, করাকে বৈধ কাজ মনে করতেন কিনা, তা যাচাই করে দেখা। আবারো উল্লেখ করছি, সুন্নী ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবে মুতা বিবাহ হারাম করা হয়েছে, এই বিষয়ে অসংখ্য ফাতোয়া রয়েছে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় মোটেও সেটি নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ খোদ এই কাজটির অনুমোদন দিয়েছিলেন কিনা, নিজে করেছেন কিনা, এই কাজটি সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত কিনা, নবীর সময়ে এই কাজটি ব্যাপকভাবে চর্চা করা হতো কিনা, এবং এটি নিষিদ্ধ কীভাবে করা হলো, সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা।