হৃদয় কৃষ্ণ যাদব
অভিনন্দন! আপনি জন্ম থেকে শুনে আসা, জেনে আসা বিশ্বাসের বাইরে চিন্তা করতে পেরেছেন। এটা খুব কঠিন কাজ এবং খুব কম মানুষই এটা করতে পারে। এখন আপনি যেকোন বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারবেন এবং একটা অদ্ভুত আনন্দ বা স্বাধীনতা অনুভব করতে পারবেন।
এখন আপনি আরও চিন্তা করুন, এটা কেন, ওটা কেন – এরকম প্রশ্ন করতে থাকুন। যেসব বিষয় নিয়ে আগে কখনো ভাবেননি সেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করুন। মজার বিষয় হলো – আপনি খুব সহজে উত্তর পেয়ে যাবেন। এবং এই প্রশ্ন-উত্তর খেলাটা বেশ মজার।
যেমন ধরুন কেন এমন একটি ভাষায় পবিত্র গ্রন্থ লেখা হলো যে ভাষায় পৃথিবীর খুব সামান্য সংখ্যক লোক কথা বলে? সেই ভাষাটি পৃথিবীর কঠিনতম ভাষার একটি। কেন সারা পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষকে বছরে একবার একটা নির্দিষ্ট শহরে যেতে হবে পূন্য অর্জনের জন্য যেখানে সারা মহাবিশ্বই বিধাতার সৃষ্টি? কেন স্বর্গের খাবারের মেনুতে আংগুরের নাম আছে কিন্তু আমাদের দেশের আম-লিচুর নাম নেই? স্বর্গের এতো স্বর্নের, হীরক খচিত বাড়ি দিয়ে আপনি কি করবেন? কোন জিনিসের এতো প্রাচুর্য থাকলে তার কি আর কোন মূল্য থাকে? স্বর্গে মাইলের পর মাইল খেজুর বাগানের মালিক হয়ে কি করবেন? কার কাছে বিক্রি করবেন? কে খাবে? স্বর্গের একমাত্র লোভনীয় জিনিস হলো ৭২ অপ্সরী তাও শুধু পুরুষের জন্য, নারীরা হবেন তার স্বামীর ৭২ অপ্সরীর সর্দারনী, এগুলো কেন এতো আকর্ষনীয়? পুরুষের একমাত্র চাহিদা কি অক্ষত-যোনী রমনী সম্ভগ যার কারনে স্বর্গে তার লোভ দেখানো হয়েছে বারংবার (Quran 55:56, 37:48-49, 52:20, 55:58, 55:72, 78:33-34, 56:22-23, 56:35-38) ? এছাড়াও পুরুষের জন্য রয়েছে গেলমান বা কিশোর 52:24, সমকামীদের পৃথিবীতে হত্যা করতে বলে স্বর্গে কেন তার লোভ দেখানো হয়? পবিত্র গ্রন্থে কেন পরবর্তীতে আবিষ্কার হওয়া আমেরিকা, হিমালয়, আমাজন, নায়াগ্রার কথা একবারও আসলো না? ৩০০০ বছর আগের ফারাওদের কথা আসলো কিন্তু তারও অনেক পরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ এ জন্মানো পৃথিবীর আরেকটি বড় ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের কথাটা আসলো না?
এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবুন, নিজেই উত্তর পেয়ে যাবেন এবং উত্তর পাওয়ার পর নিজেকে বেশ বড় দার্শনিক হিসেবে মনে হবে। একই সাথে আপনি বুঝতে পারবেন – আপনার আশে পাশের ৯০ ভাগ মানুষই চিন্তা করেনা বা করতে পারেনা। আপনি আর দশজনের চেয়ে আলাদা – এই সুখানুভূতিটা অনুভব করতে থাকুন। তোতা পাখির মত শিখিয়ে দেয়া জীবন থেকে বের হয়ে অন্য দেশ, ধর্ম, সম্প্রদায়, প্রকৃতির বৈচিত্র, সৌন্দর্য উপভোগ করুন – লাইফ ইজ বিউটিফুল।
আমি সেই হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা শিখেছি।
Think about things differently!
এই পরিবেশ যদি চান, তবে শিশুদের সেই ছোট থেকেই নিরপেক্ষ শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য জনাব মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তার ” বইতে খুব সুন্দর লিখেছেন, নীচে সেটা পড়ুন।
আমি বলেছিলাম, ইশকুলগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের বই না পড়িয়ে ‘ধর্ম পরিচিতি’ নামে আলাদা বিষয় চালু করতে। ফরজ গোসলের নিয়ম, দোযখের আজাব, এসব না আওড়িয়ে ছেলেমেয়েদেরকে চার-পাঁচটি বড় ধর্মের ইতিহাস পড়ানো হোক। কোন ধর্ম কীভাবে পৃথিবীতে এলো, এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কী কী, ধর্মগুলোর প্রধান প্রধান প্রথার বর্ণনা, এ বিষয়গুলো ছাত্র/ছাত্রীদেরকে জানানো হোক। এতে তারা অন্য ধর্মের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবে, এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীল হতে শিখবে।
মগজধোলাইকারকদের কথায় তারা তখন আর অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। ধর্মগুলোর মধ্যে একটি সহজ তুলনাও তারা করতে পারবে। ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি সমাজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে আসবে। অনেকের ধারণা, ধর্মগ্রন্থের বাণী পড়ালে বুঝি শিশুদের নৈতিক চরিত্র উন্নত হয়। এটি অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা। ধর্মীয় মোরালিটির ভিত্তি হলো ভয়। ভয় মানুষের চরিত্রকে নষ্ট করে। যে-শিশু ‘মিথ্যে কথা’ কী তা জানে না, চুরি ও অসততার সাথে যার কখনো পরিচয় ঘটেনি, পাপ সম্পর্কে যার কোনো ধারণা নেই, তাকে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার নামে এসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিশুরা অত্যন্ত কৌতূহলী প্রাণী। তাদেরকে যদি কোনো কাজ করতে আপনি নিষেধ করেন, তাহলে তারা সেটির ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহ দেখায়। কোনো শিশুকে যদি বলেন, মিথ্যে বলা মহাপাপ, তাহলে সে প্রথমেই মনে মনে ‘মিথ্যে কী’ তা জানতে চাইবে। কীভাবে কী কথা বললে সেটি মিথ্যে কথা হয়, তা সে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, এবং একসময় নিজেই পাকা মিথ্যুক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মানুষ এতো মিথ্যে কথা বলে কেন? কারণ সে শৈশব থেকেই শুনে আসছে মিথ্যে বলা মহাপাপ। এ আহাম্মকি বাণী তাকে শিশুকালেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে মিথ্যের সাথে। কোনো কথা যে মিথ্যে হতে পারে, মানুষ যে সত্যের বদলে মিথ্যে কথা বলতে পারে, এটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এখানে শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তারা বিপদে পড়লে বা ভয় পেলে খুব সহজেই মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এ শিশুরাই কিন্তু একসময় বুড়ো হয়ে লোভ ও স্বার্থ চরিতার্থ করতে মিথ্যের স্বাভাবিকীকরণ ঘটায়।
এ জন্য ধর্ম শিক্ষা বিষয়টিকে আমি পরিবারের হাতেই রাখতে চাই। ইশকুলে নয়। ইশকুলে থাকবে ধর্ম পরিচিতি, ধর্মের ইতিহাস, বিভিন্ন ধর্মের কালচারাল ফিউশন। সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া। এ ফিউশন না থাকলে রিলিজাস ইনটলারেন্স বাড়বে। ধর্মীয় বিষয়গুলোতে সমাজ অসহিষ্ণুতা দেখাবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ইনটলারেন্সের প্রধান কারণ নিজের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা রাখা। নিজের সংস্কৃতি, নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাস – এগুলোকে শ্রেষ্ঠ ভাবলে বিপদ। তখন অন্যের সংস্কৃতি, অন্যের ধর্ম, ও অন্যের বিশ্বাসকে তুচ্ছ মনে হবে। কিন্তু ছাত্ররা যদি নিজ ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মের সাথেও সমানভাবে পরিচিত হয়, তাহলে তারা দেখবে যে – অন্য ধর্মগুলোও তুচ্ছ নয়, এবং তার ধর্মটিই শুধু শ্রেষ্ঠ নয়। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের যে মনস্তাত্বিক লড়াই, যা প্রায়ই রূপ নেয় পাশবিক গুঁতোগুঁতিতে, সেটি আশা করি কমে আসবে। সমাজে টলারেন্স বা সহনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। আমি আহ্বান জানাবো, শিশুদের জন্য এমন একটি বই প্রণয়ন করতে, যেটিতে ইসলাম, হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, কনফুসিয়ানিজম, এবং জৈন – অন্তত এ সাতটি ধর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও ইতিহাস থাকবে।