সাধারণতঃ আমরা একক লেখা প্রকাশ করে থাকি আমাদের প্ল্যাটফর্মে এবং আমাদের মনোনীত এবং এই প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত লেখকরাও সেটাই পছন্দ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশ কিছু লেখা পেয়েছি যেগুলো হয়তো এককভাবে একটি লিখার দৈর্ঘ্য ধারণ করেনা, কিন্তু সামষ্টিকভাবে দেখলে দেখা যাবে এই নাতিদীর্ঘ লিখাগুলো একটি গুরূত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। বার্তাটি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের ভয়াবহতা নিয়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ভবিষ্যৎ মৌলবাদী রাষ্ট্রের অন্ধকার রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বার্তাটি পেছনে যে উদ্বেগ, সেটিকে তুলে ধরবার জন্যে আমাদের প্ল্যাটফর্মে নতুন বা অনিয়মিত যারা, তাদের কিছু ভাবনা তুলে ধরা হলো নিম্নে –

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফরিদ (৩৫, ডেমরা, ঢাকা) – আসলে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে আওয়ামী সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ বা উগ্র ইসলামী জঙ্গীবাদ বেশ খারাপের দিকে মোঁড় নিয়েছে। আমার মতো যারা নির্ভার বোধ করেছে আওয়ামী ফ্যাসিজম এর পতনে, তারাও এখন বেশ উদ্বিগ্ন সংখ্যালঘু হতে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর হামলা ও আক্রমণে। আমি আসলে অনেক বেশি চিন্তিত বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। হিযবুত তাহরির, হরকাতুল জিহাদ, শিবিরের মতো দলগুলো যদি উগ্র মৌলবাদ প্রচার ও প্রসার করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অপাংক্তেয় হয়ে যাবে বহির্বিশ্বের কাছে। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে নিশ্চিতভাবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থেই ইসলামী উগ্রতাকে দমন করতে হবে। এবং যতক্ষণ না বাংলাদেশ সমকামী, অবিশ্বাসী, হিজরা এদের ব্যাপারে আধুনিকায়ন না হলে পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে। বাংলাদেশের মধ্যপ্রাচ্যীয় তেল বা খনিজ সম্পদ নেয় যে বাংলাদেশ চাইলেই বহির্বিশ্বকে অগ্রাহ্য করতে পারবে। ইউনুস এর সরকার ইসলা্মি উগ্রবাদকে গ্রহণ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। ধর্মের ভূমিকা রাষ্ট্র থেকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ইউনুস সরকারকে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে মৌলবাদী ছাত্রনেতাদের বাদ দিয়ে হলেও।

শাহরিয়ার এমডি নাফিস খান (৩৬, মালিবাগ, ঢাকা)আওয়ামী লীগ দুঃশাসনের বিরূদ্ধে যেভাবে আমাদের ছাত্র জনতা এবং আপামর জনসাধারণ জেগে উঠেছিলেন, সেটা আমাদের মতো যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পাননি, তাদের জন্যে নতুন এক বিজয় এর চেতনা নিয়ে এসেছিলো। বাংলাদেশ, মনে হয়েছিলো, অবশেষে মুক্ত হলো শেখ পরিবারের অভিশপ্ত দখলদারিত্ব থেকে।কিন্তু বিধি বাম! হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, শিবির, যে উগ্র ইসলামী মৌলবাদী দলগুলো এতবছর লুকিয়ে ছিলো, যাদের বিষাক্ত থাবা থেকে বাংলাদেশ মুক্ত ছিল গত দেড় দশক, যাদের হিংস্রতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আওয়ামী-পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ইসলামী দলগুলোর দৌরাত্মে, তাদের যে সাম্প্রতিক আবির্ভাব, তা বাংলাদেশ নিয়ে সমস্ত আশা ভরসাকে গুড়িঁয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ঠ।সমস্ত ভাষ্কর্য, দেয়ালচিত্র, চিত্রকর্মকে যেভাবে অবমাননা করা হচ্ছে মনে হচ্ছে ১৯৭১ হয়নি, মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ভুলে যাওয়াটা প্রচন্ড দরকার এই ইসলামী উগ্রবাদীদের জন্যে। যেভাবে মহিলাদের ইরান/আফগানিস্তান ধরণে হেনস্থা করা হচ্ছে, এটা আতঙ্ক-জাগানিয়া। সমকামীদের অধিকার ও নাস্তিক/অবিশ্বাসীদের বাক-স্বাধীনতার জন্যে যে লড়াই, মনে হচ্ছে আমরা আরো ১০০ বছর পিছিয়ে গেলাম এই উগ্র হায়েনাদের কবলে পড়ে। বিএনপির মৌন অবস্থান এক্ষেত্রে ন্যাক্কারজনক।

মোহাম্মাদ আব্দুল কাদের সুমেল (৩৭, ফেনী, চট্টগ্রাম) – বাংলাদেশে সমকামীতা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ধর্মানুভূতিতের আঘাতের আইন এর মোড়কে ধর্ম নিয়ে কোনো সমালোচনা নিষিদ্ধ। নাস্তিকদের মেরে ফেলা হয়। এ কোন সমাজে আমি ছিলাম?এখন দেখছি উগ্রতম মৌলবাদীদের পুনরুত্থান আওয়ামী পতনের পর। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ধ্বংশ করবার একক এজেন্ডা নিয়ে যেন শিবির, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরীরের মতো উগ্র জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোর পুনর্জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগকে এই ধর্মান্ধ উগ্র দলগুলোকে দমিয়ে রাখার কৃতিত্ব দিতেই হয় যদিও তাদের ফ্যাসিবাদী শাসন সে কৃতিত্বকে ম্লান করে দেয়। ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়া, শিল্পকলা গুড়িঁয়ে দেয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক। এই সুযোগে এই জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে বা তাদের নিষিদ্ধ  স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হবে। ফৌজদারী দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে হবে অবিলম্বে। সমকামী/নাস্তিক/উভকামী এদের সবাইকে বাকিদের সাথে সমানভাবে দেখতে হবে। ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, রাষ্ট্রীয় নয়। আমরা ভারত, ইরান, আফগানিস্তান চাইনা। উদারনৈতিক বাংলাদেশ চাই। এই চাওয়াতে যদি আমাকে বাজে মুসলমান বলেন তথাকথিত মৌলবাদীরা, তাতেই সই।

মুহাম্মাদ জাকির হোসাইন (৪৫, পঞ্চকাঠি, শরীয়তপুর) ধর্ম যে একটা ব্যক্তিগত বিষয় এবং মারামারি, যুদ্ধ, হানাহানির বিষয় নয়, সেটা বুঝতে আমার সময় লেগেছে অনেক। ধর্মান্ধ এক দেশে জন্ম, স্বাভাবিকভাবেই এইসব গোঁড়ামি থেকে বেরুতে কয়েক দশক লেগে যায়। তার ওপর হুমায়ুন আজাদ, অভিজিত রায় সহ প্রমুখের হত্যা এবং আক্রমণের শিকার হওয়া চোখ এড়াইনি। এরা সবাই ধর্মান্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সমালোচক ছিলেন। কেউ কট্টর কঠিন ছিলেন সমালোচনায়, কেউ একটু মিষ্টি। কিন্তু পরিণতি উগ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বেঘোরে প্রাণ দেয়া বা আহত হওয়া।

মুনায়েম আহমেদ (২৯, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট) – আমি আমার স্বল্প বুদ্ধিতে যা বুঝেছি তা হলো বাংলাদেশ যদিও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, এটি আসলে উগ্র ইসলামিক দেশ নয়, যেটা হিযবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ, হেফাজত, জামাত/শিবির মনে করে বা আশা করে। এই প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের ইরান এর মতো হওয়াটা খুবই বাজে একটা ব্যাপার হবে। যেখানে নারীদের কোনো অধিকার নেই, সমকামী/অবিশ্বাসীরা মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায় শুধু, তেমন একটা দেশের মতো হয়ে কী লাভ বাংলাদেশের?

আবুবক্কর সিদ্দীক (২৮, অঙ্গারিয়া, শরিয়তপুর) – বাংলাদেশ মানে যদি হয় সকল ইসলামীয় মতবাদ এবং তদসংক্রান্ত অনুশীলনের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং ‘অন্যদের’ বিরুদ্ধে কুসংস্কার এবং ঘৃণার ধীর-স্থির এবং অতীব যত্নশীল লালন-পালন, তাহলে সে-বাংলাদেশ এর জন্ম না হওয়াই হয়তো ভালো ছিল। এখানে ‘অন্যরা’ বলতে সমকামী, ট্রান্সসেক্সুয়াল, উভকামী, নাস্তিক, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্যদের বোঝায়। এখনের যে উগ্র মৌলবাদী আস্ফালন, তা কিন্তু সেই মুসলিম মনোভাব এর পরিচায়ক যেটা বলে মুসলিমরা অন্য সকলের চেয়ে ভালো এবং এটিই মানব-সভ্যতার শেষ ধর্ম। কী ভয়ঙ্কর আত্মপ্রেমী বিভ্রম! এই বিভ্রম থেকে বেরুতে না পারলে মুসলমানিত্ব কুলাঙ্গারিত্বে পরিণত হবে। যদিও বলতে হয় অত্যাচার নিগ্রহে মুসলমানেরা ইহুদীদের চেয়েও এগিয়ে আছে অনেক।

মিজানুর রহমান (৪৯, বাঘা, রাজশাহী) – আওয়ামী লীগ এর পতনে আমি উল্লসিত ছিলাম, কিন্তু ইসলামের নামে দুঃশাসন, ঘৃণা মেনে নেয়া যায়না। নাস্তিক, সমকামী, সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। এইসব জঙ্গীবাদীদের কোনো স্থান নেই বাংলাদেশে। ০৫ অগাস্ট ২০২৪ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এটি নিশ্চিত করে দেখিয়ে দিয়েছে – আওয়ামী শাসনামলে হয়তো অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল, দুর্নীতি হয়তো যদ্দূর সীমিত বা দূরীভূত করা দরকার ছিল, তা-তে সরকার ব্যার্থ হয়েছিল, কিন্তু ইসলামী উগ্রবাদ তথা জঙ্গীবাদ দমনে আওয়ামী লীগ যে মারাত্মকভাবে সফল ছিলো, তার প্রমাণ গত ছয় মাস তুলে ধরেছে। এইসব ইসলামী দলগুলো যে আসলে বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, তা-র প্রমাণ কিন্তু এখন এন্তার। ছাত্র ছদ্মবেশী ইসলামী জঙ্গীরা ইরান চায়, আফগানিস্তান চায়, ইসলামী শাসনব্যবস্থা চায় মধ্যযুগীয় প্রেরণায়। বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস – শিল্পকলা, ভাষ্কর্য, চিত্রশিল্প গুঁড়িয়ে দিয়েছে এরা ইসলামের নামে।

মহিউদ্দীন মিয়া  (২৬, বোয়ালমারী বাজার, বোয়ালমারী, ফরিদপুর) – একসময় নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়েছিলাম ইসলামী উম্মহার কথা, শরীয়া-ভিত্তিক রাষ্ট্রকল্পের কথা। ঘৃণা করতে করতে বড়ো হয়েছি সমকামীদের, নাস্তিকদের, হিজরাদের, উভকামীদের, কাফির-নাসারাদের। উন্নত বিশ্বে কাফির নাসারাদের মাঝে থেকে বুঝতে পেরেছি কী ভয়ঙ্কর ঘোল খাইয়েছে ইসলাম ধর্ম সারাটাজীবন। এখানে সমকামী, উভকামী, নাস্তিক, আস্তিক, হেটেরোসেক্সুয়াল, কারো কোনো ভেদাভেদ নেই আইনের দৃষ্টিতে। একসময় ছিলো। এখন নেই বলতে গেলে। একেই বলে সভ্যতা। আমাদের দেশে কী হচ্ছে? হিন্দু পালাচ্ছে। নাস্তি্ক/সমকামী/উভকামীরা হারিয়ে গেছে। মধ্যযুগীয় উগ্রবাদী বর্বরতা চর্চা না করলে যেন বাংলাদেশের মুসলমানদের রেহাই নেই। হিযবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ, শিবির, হেফাজত – এদের উগ্রতার, ধর্মান্ধতার শিকার গোটা বাংলাদেশ। পশ্চাৎপদ বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশে এদের তাণ্ডব দেখলে বুঝতে পাই কী বিভীষিকাময় এদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। ইসলাম ধর্মের এইসব ধারক বাহক এবং এই টাইপ এর ইসলামকে বর্জন করতে না পারলে বাংলাদেশ সম্পূর্নভাবে একটা মধ্যযুগীয় ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

মোঃ মাজহারুল ইসলাম (৩৫, লাকসাম, কুমিল্লা) – আওয়ামী পতনের পর উগ্র মৌলবাদ মাথাচারা দিয়ে উঠলেও এ-ব্যাপারে কোনো সংশোধনীর বা সংস্কারের কোনো কথা নেই কারো মুখে। অথচ এই জায়গায় দরকার ছিল সবচেয়ে বড়ো সংস্কার।প্রথমতঃ সংবিধান থেকে কোনো ধর্মের প্রাধান্য বাদ দেয়া। এটা খুব গুরূত্বপূর্ণ। কারণ এটা না হলে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ব্যাপারটা থেকেই যাবে, আর বৈষম্য ও অসন্তোষ থেকেই যাবে। ভারতের মোদীর মতো হওয়া চলবেনা।দ্বিতীয়তঃ, সমকামীতাকে ফৌজদারী দন্ড দেয়ার মতো অপরাধ গণ্য করা যাবেনা। ৩৭৭ এর অবলুপ্তি বা সংস্কার প্রয়োজন। এটা না হলে আবারো রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক রূপ থেকেই যাবে।তৃতীয়তঃ, ধর্মের প্রচার ও প্রসার এমনভাবে করা লাগবে যাতে এটা চাপানো মনে না হয়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আইন করে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। নাহলে ইসরায়েল এর মতো দেশে পরিণত হতে হবে।অনেক কট্টরপন্থী হয়তো বেজার হবেন। আমাকে নাস্তিক ঠাউরাবেন। কিন্তু মুসলমানের আধুনিক যুগের সাথে না হাঁটলে তারা হারিয়ে যাবে মহাকালের ভীড়ে।

মোহাম্মাদ শহীদুল ইসলাম জায়গীরদার (৪০, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট) – আমি কখনো ভাবিনি আমি এমন কোনো সাইটে লিখা জমা দেব। কিন্তু গত ৭ মাসের ঘটনায় আমার ইসলামিক মূল্যবোধে আঘাত এসেছে বারবার। বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি যেভাবে শিবির, হিযবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ এর মতো দলগুল দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমি হতবাক হয়ে গেছি। ইসলামের নামে, ইসলামী শাসন কায়েমের নামে সংখ্যালঘু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের ওপর যেভাবে হামলা হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক। আমিও সমকামীদের ঘৃণা করতাম, নাস্তিকদের অবৈধ ভাবতাম। কিন্তু এখন বুঝি ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় উন্মাদনা ধ্বংস ছাঁড়া কিছু ডেকে আনেনা। আওয়ামী লীগ এর পতনে আমি উল্লসিত ছিলাম, কিন্তু ইসলামের নামে দুঃশাসন, ঘৃণা মেনে নেয়া যায়না। নাস্তিক, সমকামী, সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। এইসব জঙ্গীবাদীদের কোনো স্থান নেই বাংলাদেশে।

জুবায়ের আহমেদ (৩৮, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট) গত ৫ মাসের ঘটনায় আমার ইসলামিক মূল্যবোধে আঘাত এসেছে বারবার। বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি যেভাবে শিবির, হিযবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ এর মতো দলগুল দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমি হতবাক হয়ে গেছি। ইসলামের নামে, ইসলামী শাসন কায়েমের নামে সংখ্যালঘু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের ওপর যেভাবে হামলা হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক। আমিও সমকামীদের ঘৃণা করতাম, নাস্তিকদের অবৈধ ভাবতাম। কিন্তু এখন বুঝি ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় উন্মাদনা ধ্বংস ছাঁড়া কিছু ডেকে আনেনা। 

এমডি জাকির হোসাইন (৩৩, অঙ্গারিয়া, শরীয়তপুর) বাংলাদেশ এক আজব দেশ। এখানে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত ডুবে থাকে আকন্ঠ দূর্নীতিতে, এখানে অপরাধ যেন এক স্বাভাবিক বিষয়। খুন, ধর্ষন, রাহাজানি। একে অপরকে কষ্ট দেয়া, সীমাহীন অন্যায় এখান এওতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে এই বাংলাদেশে সমকামিতা যেন এক অপরাধ।সমকামিতা কেন অপরাধ? কেন ভালোবাসা অপরাধ এই বাংলাদেশে, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ত সম্ভবপর নয় এখানে। তবে ধর্ম বিষয়ক বিধি নিষেধ যে এটিতে প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রাখে তা বলা বাহুল্য।এই দেশে আর কিছু পারুক কিংবা না পারুক, চুরি-চামারী করার পর যেভাবে আল্লাহ-খোদার নাম নিতে থাকে যেন চুরি করবার পর এই আল্লাহর নাম নিলেই সব খুন মাফ। সারাদিন চুরি করবে, সারাদিন খুন করবে, ধর্ষন করবে এবং ঘরের মধ্যে মক্কার ছবি রাখলেই যেন অপরাধ থেকে মুক্তি। এইসব ছদ্মবেশী খুনী-ধর্নবাজরাই যেন আজকে এক একটা বাংলাদেশের উদাহরণ হয়ে রয়েছে। ৫ই অগাস্টের পর যে তেলাপোকার মতো ইসলামিস্টদের উত্থান, তাতে এই দেশের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে মধ্যযুগে চলে যাওয়া ছাঁড়া গতি নেই।

মোহাম্মাদ শামীম আল মামুন (৪৭, ঢাকা) –  এই জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে বা তাদের নিষিদ্ধ  স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হবে। ফৌজদারী দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে হবে অবিলম্বে। সমকামী/নাস্তিক/উভকামী এদের সবাইকে বাকিদের সাথে সমানভাবে দেখতে হবে। ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, রাষ্ট্রীয় নয়। আমরা ভারত, ইরান, আফগানিস্তান চাইনা। উদারনৈতিক বাংলাদেশ চাই। এই চাওয়াতে যদি আমাকে বাজে মুসলমান বলেন তথাকথিত মৌলবাদীরা, তাতেই সই।

মোহাম্মেদ হাসান আহমেদ (২৭, হাজীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট) আমি নিজেকে একজন সাধারণ রক্ষণশীল মুসলমান হিসেবেই জেনে এসেছি সারাজীবন। নাস্তিকদের ঘৃণা করা, সমকামী/উভকামী/হিজরাদের অসভ্য বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সমাজের অপাংত্তেয় অংশ হিসেবে দেখাটাকেই স্বাভাবিক ভেবেছি। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তিকে ভেবেছি সবসময় মৃত্যুদন্ড দেয়ার মতো পাপ। একই যুক্তি অন্য ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু আরোপ করিনি। কারণ বাকিগুলোকে “ভূয়া” ধর্ম ঠাওরে এসেছি। কিন্তু সারাজীবনের সঞ্চিত এই ঘৃণাগুলো (মূল্যবোধ-ও বলা চলে) বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছি পাশ্চাত্যে অধুনাবিশ্বে আসবার পর। পাশ্চাত্য দুনিয়াকে বর্ণবাদের আলোকে দেখবার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বাংলাদেশের সেই রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের মূল্যবোধগুলো একে একে ফিকে হয়ে গেলো। এখানে দেখলাম নাস্তিকদের ওপর কেউ চড়াও হয়না। চার্চ নিয়ে কটূ কথা বললে কোনো উগ্র মৌলবাদী খ্রীস্টান হামলা করে বসেনা। সমকামীদের সাধারণ সবার মতোই সম-অধিকার নিয়ে চলতে দেখি। কিছু রদ্দিকালের বৈষম্য হয়তো রয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে, কিন্তু আইনের শাসন খুবই কড়া এবং সমকামী/উভকামীদের সমস্ত মানবাধিকার নিয়ে অকুন্ঠচিত্তে জীবনধারণ করতে দেখি। অথচ বাংলাদেশে সমকামীতা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ধর্মানুভূতিতের আঘাতের আইন এর মোড়কে ধর্ম নিয়ে কোনো সমালোচনা নিষিদ্ধ। নাস্তিকদের মেরে ফেলা হয়। এ কোন সমাজে আমি ছিলাম?

গাজী মোহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম (২৭, উজানচর, কুমিল্লা) – বাংলাদেশের প্রশাসনসহ সেনাবাহিনীর ভেতরে জামায়াতের মতাদর্শী জিহাদি গোষ্ঠী, জিহাদি জঙ্গি, বাংলাকে শ্মশান বানানোর জন্য, আফগানিস্তানের মডেলের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানচিত্র ও নারীদের স্বাধীনতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সকল মুক্ত মত ও চিন্তার স্বাধীনতাকে কালো কাপড়ের আবরণ পরিয়ে দিতে চায়। যথারীতি স্ব-স্ব জায়গা থেকে এইসব উগ্রবাদীরা গলা উঁচু করে হুংকার দিয়ে যাচ্ছে। এই অপশক্তিকে নামিয়ে দিয়েছে তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টা কমিটি। এই জিহাদি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রকাশ্যে হিন্দু সংখ্যালঘু বলে, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে খুন করছে, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, মা-বোনদের বিবস্ত্র করে সম্মানহানি এবং নির্যাতন করছে। এ যেন ধর্মের ফোবিয়া গ্রাস করেছে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের মূল উঠিয়ে ফেলতে রুদ্ররূপ ধারণ করে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত এই জিহাদিরা। দেশে অসংখ্য কুৎসিত জঞ্জাল তৈরি করা হয়েছে, এর যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর প্রতিনিয়ত জুলুম, অত্যাচার, খুন, জবরদস্তি, উচ্ছেদ করে সম্পত্তি দখল করা, মুক্তমনা, নাস্তিক গোষ্ঠীকে করা হয়েছে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। নাস্তিকদের হত্যা করতে পারলেই যেন বেহেশত নিশ্চিত। বেহেশতে যাওয়ার নেশা আর হুরের সাথে সংগমের লোভাতুর কাম জেগে উঠেছে এইসব জিহাদি গোষ্ঠীর অন্তরে। ১৪০০ বছর আগের কোরআন, কালো পতাকা, মৌলবাদের বুনো উল্লাস আর কালো জঙ্গি পতাকার উত্তোলন এ দেশে রুখে দিতে হবে। বাংলাদেশ কি জামাতী তালেবানদের হাতে চলে যাবে, নাকি আমরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলব? সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।