ভূমিকা

ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের কাছ থেকে আমরা শুনে এসেছি, “সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা বলিবে না।” এমনকি, নিজের কোন সাময়িক সুখ বা উপকারের জন্য হলেও, সত্যি কথাই বলতে হবে, আর মিথ্যা এড়িয়ে চলতে হবে। ছোটবেলা মায়ের মুখে একটি গল্প শুনতাম, গল্পটি ইসলামের অন্যতম প্রখ্যাত আল্লাহর ওলি বায়োজিদ বোস্তামীর। গল্পটি এরকম ছিল, একবার হযরত বায়েজিদ বোস্তামীকে তার মা কিছু স্বর্ণমুদ্রা জামার গোপন জায়গাতে লুকিয়ে কোথাও পাঠিয়েছে। পথের মধ্যে ডাকাত বোস্তামীকে ধরলো এবং জিজ্ঞেস করলো, তার কাছে অর্থ সম্পদ আছে কিনা। সত্যবাদী বায়োজিদ বোস্তামীকে তার মা শিখিয়েছিল, সদা সত্য কথা বলতে। সত্যের বিজয় হবেই। সর্বদা যারা সত্যের পথে চলে, তারা ছোটখাট সমস্যায় পড়লেও শেষ পর্যন্ত তাদেরই বিজয় হয়। তাই বায়োজিদ বোস্তামী ডাকাত সর্দারের কাছে তার স্বর্ণমুদ্রা থাকার সত্য কথা বলে দিলো। ডাকাত সর্দার অবাক হলো, এবং জিজ্ঞেস করলো সে কেন সত্য বললো! বায়োজিদ বোস্তামী ডাকাত সর্দারকে জানালেন, তার মা তাকে সদা সত্যের পথে থাকতে বলেছেন। এতে সাময়িক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত সত্যের পথের মানুষেরই জয় হয়। এমনকি, জয় না হলেও, সদা সত্যের পথেই সকলের থাকা উচিত। এইসব গল্পের সত্যতা কতটুকু তা প্রশ্ন সাপেক্ষ, তবে ছোটবেলা থেকে এধরণের ধর্মীয় নেতা পীর আউলিয়াদের গল্প শুনেই আমরা নীতি নৈতিকতার পাঠ নিই। কিন্তু, ইসলামে প্রয়োজন অনুসারে, নিজের লাভের জন্য মিথ্যা বলা কী জায়েজ? ইসলামে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি দেয়া আছে, সেসব পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখা হবে। আপাতত আমাদের আজকের বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ পাক কী কখনো মিথ্যা বলতে পারেন কিনা। আমরা জানি, নিজের লাভের জন্য মিথ্যা বলা অপবিত্র শয়তানের কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজটি আল্লাহ পাকও কখনো করেছেন কিনা।

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা নানা সময়ে মিথ্যা বলি। কিন্তু সেই মিথ্যাগুলো বেশিরভাগ সময়ই হয় আমাদের নানা ধরণের অক্ষমতার জন্য। যেমন ধরুন, আমার সন্তান একটি দামী গাড়ি কিনতে চাইলো। আমি মিথ্যা করে তাকে বললাম, এই গাড়িটি কাল কিনে দিবো। কিন্তু আসলে আমি কাল তাকে কিনে দিবো না। আবার অনেক সময় ভয়ে আমরা মিথ্যা বলি। যেমন ধরুন, একটি অন্যায় আমি করে ফেলেছি। সেই অন্যায় কাজটি গোপন করার জন্য আমরা মিথ্যা কথা বলি। দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি মিথ্যাই হয় আমাদের অক্ষমতার কারণে। একমাত্র বদমাইশ লোকই ক্ষমতা থাকার পরেও মিথ্যা বলে, নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য। কিন্তু আল্লাহর তো কোন অক্ষমতা নেই। তিনি তো চাইলেই সব পারেন। তাহলে তিনি কেন মিথ্যা বলবেন? তিনি কেন নিজের কোন সুবিধা আদায়ের জন্য বদমাইশদের মত মিথ্যা বলবেন?

ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাক হচ্ছেন সকল প্রকারের পাপ মুক্ত, তিনি খারাপ বা অশুভ বিষয় এরকম সকল কিছুর উর্ধ্বে। এমনকি, তার প্রেরিত নবী হচ্ছেন সর্বকালের সর্বযুগের জন্য নীতিনৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড। কিন্তু এই আল্লাহ পাক কিংবা তার নবী কী মিথ্যা বলতে পারেন? ইতিপূর্বে অনেকগুলো লেখাতে নবী মুহাম্মদের নানান কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, আমাদের আজকের আলোচনা হচ্ছে আল্লাহ পাক সম্পর্কে। আল্লাহ পাক প্রয়োজন অনুসারে কখনো মিথ্যা কথা বলেন কিনা, সেটি যাচাই করে দেখার জন্য।

অনেক সময় অনেক মুসলিম দাবী করেন যে, নবী মুহাম্মদ যা যা বলেছেন প্রতিটি কথাই পরবর্তীতে সত্য হয়েছে। যা ভবিষ্যতবাণী করেছেন, সবই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এরকম বেশ কয়েকটি উদাহরণ দেখানো যায় যে, নবী মুহাম্মদ যা বলেছিলেন, বা আল্লাহ তাকে যা জানিয়েছিল, সেগুলো পরবর্তীতে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু চতুরতার সাথে নবী মুহাম্মদ সেই কথাটিকে আল্লাহ পাকের মোজেজা হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আল্লাহ ইচ্ছা করেই নবীর সাহাবীদের ভুল বা মিথ্যা জানিয়েছিল, ভাল কোন উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ পাক ভাল উদ্দেশ্যেও মিথ্যা কেন বলবেন? মহাবিশ্বের সর্বক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ পাকের মিথ্যা বলা কী আদৌ সম্ভব? ঘটনাটি সংক্ষেপে বলছি।

একবার নবী মুহাম্মদ এবং তার সাহাবীগণ যুদ্ধে গিয়েছেন। আল্লাহ পাক এরকম সময়ে নবীকে স্বপ্নে দেখালেন যে, বিপক্ষের কাফেরদের যোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক কম। এই স্বপ্ন দেখে তিনি তার সাহাবীদের বিষয়টি জানালেন। সাহাবীরা খুশী মনে যুদ্ধে গেল। যুদ্ধে গিয়ে দেখা গেল বিপক্ষের কাফেরদের সংখ্যা অনেক বেশী। এই যুদ্ধে মুসলিমদের জয় হওয়ার পরে সবাই মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহ তো জানিয়েছিল কাফেররা সংখ্যায় কম। তাহলে তারা সংখ্যায় এত বেশী হলো কীভাবে? উত্তরে মুহাম্মদ সাথে সাথেই একটি আয়াত নাজিল করে ফেললেন এবং তার সাহাবীদের বোঝালেন, আল্লাহ ইচ্ছে করেই এই মিথ্যাটি বলেছিলেন, যেন মুসলিমদের মনোবল অটুট থাকে। যেন তারা ভীত হয়ে পালিয়ে না যায়।

কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কেন এই মিথ্যাটি বলতে হলো, সেটি খুবই হতাশ করা বিষয়। কারণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহ চাইলেই একলক্ষ বা এককোটি ফেরেশতা পাঠিয়ে কাফেরদের তুলোধোনা করে ফেলতে পারতেন। তাহলে তার আর মিথ্যা বলার দরকার হতো না। কিন্তু সেটি না করে উনি মুহাম্মদকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখালেন, যেন মুহাম্মদের সাহাবীগণ যুদ্ধ করতে যায়। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ প্রয়োজনে মিথ্যাও বলেন। অথবা, মুহাম্মদের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয়েছিল, যা ঢাকার জন্য তিনি আল্লাহর আয়াত নামিয়ে ফেললেন! আসুন, কোরআনের আয়াতগুলো পড়ি।

কোরআনে আল্লাহর মিথ্যা বলা

ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ পাক একটি যুদ্ধের সময় মুহাম্মদকে একটি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল স্বপ্নে দেখা বিষয়টি সত্য নয়। তখন আল্লাহ পাক আরেকটি আয়াতের মাধ্যমে জানালেন, তিনি ইচ্ছে করেই এই মিথ্যা কথাটি বলেছিলেন। যেন সাহাবীদের যুদ্ধের মনোবল অটুট থাকে 

আল্লাহ কি প্রতারণা বা কৌশল করেন?

ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাক হচ্ছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চালাকি করা, ধূর্ততা বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া, এসব আমাদের মত সাধারণ মানুষের সাধারণ কাজ হতে পারে। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক কেন এই ধরণের কাজ করতে যাবেন, তা এক অবাক করার মত বিষয়। যার কাছে সর্বময় ক্ষমতা, যিনি হুকুম দিলে মহাবিশ্ব গ্রহ নক্ষত্র নিমিষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়, তিনি মানুষের কৌশল দেখে পাল্টাপাল্টি কৌশল করছেন, বিষয়টি আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। যেন দুই পাড়ার দুই মাস্তানের যুদ্ধ, যেখানে দুইজনই একজন আরেকজনকে পরাজিত করতে প্রতারণা করছে!

সূরা আল-ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে الماكرين শব্দটি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আল্লাহ সবচেয়ে বড় প্রতারক বা ধূর্ত। আপনারা চাইলে এই শব্দটির অনুবাদ বিভিন্ন ডিকশনারিতে খুঁজে দেখুন, এটির অর্থ হচ্ছে প্রতারক বা ধূর্ততার সাথে যে কৌশল করে বা কুটকৌশলী। কিন্তু এই আয়াতটির বাঙলা অনুবাদে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহকে মোলায়েম করে কৌশলী বলা হয়েছে।

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে এটি খুবই স্পষ্ট যে, আল্লাহ পাক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ইচ্ছায় মিথ্যা বলেছেন। ইসলামকে তিনি বিজয়ী করার জন্য মিথ্যা বলেন। তার রাজত্ব কায়েমের জন্য তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন। তিনি প্রতিপক্ষকে হারাবার জন্য প্রতিপক্ষের মতই কৌশল বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। একই সাথে নবী মুহাম্মদের চরিত্রও একদম এক। তিনিও যুদ্ধে ধোঁকাবাজী বা ধাপ্পাবাজীর অনুমতি দেন, এমনকি যুদ্ধের বাইরেও প্রতারণামূলকভাবে কাউকে খুন করাবার অনুমতি দেন। সেই সাথে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কৌশলও বলে দেন। কিন্তু আল্লাহর মত সর্বশক্তিমানের জন্য সামান্য বিষয়ে মিথ্যা বলার বিষয়টি মেনে নেয়া কষ্টকর। এর থেকে বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদই বানিয়ে এসকল আয়াত নাজিল করতেন, এবং তার সাহাবীদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য বানিয়ে বানিয়ে অনেক ভবিষ্যতবানী। সেগুলোর মধ্যে কিছু পরবর্তীতে সত্য হলে তিনি বড়াই করে বলতেন, দেখেছো, আল্লাহ কখনো মিথ্যা বলে না। আবার কিছু কথা যখন ভুল হতো, কিছু ভবিষ্যতবানী যখন মিথ্যা প্রমাণিত হতো, তিনি আরেকটি আয়াত নামিয়ে ফেলতেন এই বলে যে, আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কিংবা মনোবল বৃদ্ধির জন্য ইচ্ছে করে মিথ্যা বলেছেন। মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ কিছু তুচ্ছ কাফেরের সাথে মারামারিতে জেতার জন্য মিথ্যা বলবেন, এরকম হাস্যকর কথা একমাত্র নির্বোধ মানুষই বিশ্বাস করবে। এগুলো সবই যে আসলে নবীর ধূর্ত মাথার চালাকি, এই বিষয়গুলো এখান থেকে খুব পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে।