রাজীব সাহা, যুক্তরাজ্য
বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হিন্দু ধর্মালম্বীদের অবস্থান একটি সংবেদনশীল এবং ঐতিহাসিকভাবে জটিল বিষয়। উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান দীর্ঘদিনের। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, ১৯৭১-এর গণহত্যা, এবং স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। এই ব্লগে আমরা ইতিহাস, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ—তিনটি স্তরে বিষয়টি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করব।
ইতিহাসের পাতায় নির্যাতনের প্রেক্ষাপট
বাংলার ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম একসাথে বসবাস করলেও ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে সাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ‘অন্য’ পরিচয় তৈরি করা হয়েছিল, যার ফলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা হয়ে ওঠে সন্দেহের চোখে দেখা একটি জনগোষ্ঠী।
দেশভাগ ও ভিটে মাটি হারানোর বেদনা
দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বিপুলসংখ্যক হিন্দু নাগরিক তাদের সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, জমি হারান। ‘Enemy Property Act’ পরবর্তীতে ‘Vested Property Act’-এ রূপান্তরিত হয়ে হাজার হাজার হিন্দুর জমি রাষ্ট্র বা প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে যায়। এই আইন হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭১—হিন্দুদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পিত নিপীড়ন
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বেছে বেছে হিন্দু গ্রাম, হিন্দু মহল্লা ও হিন্দু নারীধীকার এলাকায় আক্রমণ চালায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উল্লেখ আছে, পাকিস্তানি সেনারা ‘হিন্দু’ পরিচয় পেলেই হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পরও এই ঘটনাগুলো পুরোপুরি স্বীকৃতি বা ন্যায়বিচার পায়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নির্যাতনের ধারাবাহিকতা
স্বাধীনতার পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থাকলেও বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাথে সাথে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান
১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসনের সময় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করা হলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আরও দুর্বল হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই হিন্দুদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে, যা তাদেরকে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলে। নির্বাচনের সময় প্রায়শই দেখা যায় হিন্দু পল্লিতে হামলা, লুটপাট, ভোট কেন্দ্র দখল ইত্যাদি।
ভূমি দখল ও জোরপূর্বক উচ্ছেদ
হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের বড় কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাদের জমি দখল। অপেক্ষাকৃত সংগঠিত রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো সহজেই সংখ্যালঘুদের জমি দখল করতে সক্ষম হয়। অনেক সময় দেখা যায় গ্রাম্য বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ বা রাজনৈতিক শত্রুতাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সমাজে হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতা
নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
বিভিন্ন মানবাধিকার রিপোর্টে হিন্দু নারীদের উপর ধর্ষণ, নির্যাতন, অপহরণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে উল্লেখ আছে। প্রায়ই এসব ঘটনা রিপোর্টই হয় না।
মন্দির, মূর্তি ও পূজা মণ্ডপে হামলা
প্রতিবছর দুর্গাপূজা বা অন্য যেকোনো বড় উৎসব এলেই মন্দিরে হামলা, মূর্তি ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া পোস্ট বা অপপ্রচারের ইঙ্গিতেই কখনো কখনো পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাম্প্রদায়িক উস্কানি
ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গত এক দশকে বারবার ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া আইডি, ট্রল পেজ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ব্যবহার করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে নীরব।
ভবিষ্যৎ—সমাধানের পথ কোথায়?
আইনের কঠোর প্রয়োগ
নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করলে সমস্যা কখনোই কমবে না। প্রতিটি হামলা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত করতে হবে।
শিক্ষা ও সচেতনতা
সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ভাঙতে স্কুল পর্যায়ে মানবিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মনে ছোটবেলা থেকেই সহনশীলতা গেঁথে দিতে হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভুয়া পোস্ট ঠেকাতে দ্রুত তদন্ত ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব
বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। হিন্দু সম্প্রদায় শুধু সংখ্যালঘুই নয়—তারা এই ভূখণ্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি অপরিহার্য অংশ।
উপসংহার
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মালম্বীদের উপর নির্যাতন নতুন কিছু নয়—এটি ইতিহাস, রাজনীতি, সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক স্বার্থের এক জটিল সমন্বয়। তবে সমাধান অসম্ভব নয়। সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়বদ্ধতা—এই চারটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
