বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এর সামাজিক কাঠামো মূলত ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ফলে যেকোনো ভিন্ন জীবনধারা বা পরিচয়—বিশেষ করে সমকামিতা বা LGBTQ+ (Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender, Queer ইত্যাদি)—নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের অজ্ঞতা, ভয়, ঘৃণা বা ভুল বোঝাবুঝি বিদ্যমান।

এই লেখায় আমরা আলোচনা করব—

  • সমকামিতা আসলে কী?
  • বাংলাদেশে সমকামী ব্যক্তিদের বাস্তব অবস্থা
  • কেন তারা এত সমস্যার মুখোমুখি?
  • আইন, ধর্ম, সমাজ — কোনটি কী বলছে?
  • সমাধান কীভাবে সম্ভব?

সমকামিতা কী? বিকৃতি নাকি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য?

অনেকেই মনে করেন — “সমকামিতা পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে এসেছে, আগে এমন কিছু ছিল না।” কিন্তু ইতিহাস এবং বিজ্ঞান উভয়ই প্রমাণ করে সমকামিতা মানুষের মধ্যে আদিকাল থেকেই ছিল

  • প্রাণীর মধ্যেও (ডলফিন, বানর, সিংহ, এমনকি পাখি পর্যন্ত) ১৫০০-এরও বেশি প্রজাতিতে সমকামী আচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
  • মনোবিজ্ঞানে (WHO) 1990 সালেই ঘোষণা করেছে — সমকামিতা কোনো মানসিক রোগ নয়।
  • হাদিস ও পুরাণসহ ধর্মীয় গ্রন্থেও সমকাম মানুষের উল্লেখ আছে—যদিও তা সাধারণত নিন্দাসূচকভাবে উপস্থাপিত।

অর্থাৎ সমকামিতা কোনো ফ্যাশন নয়, বরং মানুষের একটি স্বাভাবিক যৌন প্রবণতা যা জন্মগতভাবেই তৈরি হয়।


বাংলাদেশে সমকামী মানুষ কারা? কীভাবে তারা বাঁচে?

অনেকেই “সমকামী” শব্দ শুনলেই ধরে নেন এটি কেবল যৌনতার বিষয়। কিন্তু আসলে এটি পরিচয় ও আবেগের বিষয়

  • একজন সমকামী ছেলে তার নিজের মতো আরেক ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যেমন একজন হেটারোসেক্সুয়াল ছেলে মেয়ের প্রতি হয়।
  • একজন সমকামী মেয়ে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে
  • বাইসেক্সুয়ালরা উভয় লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।
  • ট্রান্সজেন্ডাররা (হিজড়া) অনেকসময় আবার আলাদা ক্যাটাগরি — তারা লিঙ্গ পরিচয় অনুযায়ী পুরুষ বা নারী হিসেবে নিজেকে মেলাতে পারে না।

এই মানুষগুলো আপনার আশেপাশেই আছে — কিন্তু আপনি জানেন না, কারণ তারা তাদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতেই বাধ্য।


সমকামীদের প্রধান সমস্যা কী?

১. আইনগত বাধা: ৩৭৭ ধারা

ব্রিটিশ আমলের আইন দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বলছে — “প্রকৃতির বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক” শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই আইনের মাধ্যমে সমকামীদের যেকোনো শারীরিক সম্পর্ক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় — যদিও বাস্তবে মামলা কম হয়, কিন্তু আইনটি পুলিশি হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের জন্য ব্যবহৃত হয়।

২. পারিবারিক চাপ ও বিয়ে

সমকামী একজন ছেলে বা মেয়ে যখন তার পরিবারের কাছে সত্যিটা বলার চেষ্টা করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে—

  • জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়,
  • ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়,
  • মারধর করা হয়,
  • অথবা সম্পূর্ণভাবে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়।

ফলে তাদের অনেকেই ডিপ্রেশন, আত্মহত্যাপ্রবণতা বা বাসা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মতো পরিস্থিতির শিকার হয়।

৩. সামাজিক হেয়প্রতিপন্নতা ও সহিংসতা

২০১৬ সালে রূপবান ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু তনয় মজুমদারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর বাংলাদেশে LGBTQ+ আন্দোলন আরও গোপন হয়ে যায়।

অনেকে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বন্ধুমহলেও নিয়মিত—

  • গালি শুনে: “হিজড়া”, “গে”, “মেয়েলি”, “বিকৃত মানসিকতা”
  • উপহাসের শিকার হয়,
  • শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হয়।

ধর্ম কী বলে?

বাংলাদেশে প্রধান ধর্ম ইসলাম, এবং ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামিতাকে নিষিদ্ধ (হারাম) হিসেবে দেখা হয়। তবে এখানে দুটি বিষয় আলাদা করা জরুরি —

বিষয়শারীরিক কাজআবেগ বা প্রবণতা
ধর্ম কী নিন্দা করেসমকামী যৌন সম্পর্কনিজস্ব আকর্ষণ থাকা মাত্র নিন্দা করে না

অনেক ধর্মীয় আলেম বলেন — “প্রবণতা থাকতেই পারে, সেটা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করা যাবে না।”

অর্থাৎ অনেকেই বলেন — সমকামী হওয়া পাপ নয়, বরং সম্পর্ক করা পাপ।
এই ব্যাখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে।


সমাধান কী হতে পারে?

✅ ১. আইন সংশোধন করা জরুরি

৩৭৭ ধারার মতো পুরনো আইন ভারত, নেপাল, ভুটান — সবাই বাতিল করেছে। বাংলাদেশ এখনও করেনি। তবে অন্তত এই আইন যেন ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।

✅ ২. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সাপোর্ট হটলাইন থাকা উচিত

অনেক সমকামী তরুণ আত্মহত্যা করে — শুধু প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে। তাদের জন্য হেল্পলাইন, কাউন্সেলিং, সাপোর্ট গ্রুপ থাকা দরকার।

✅ ৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা বৃদ্ধি

স্কুল-কলেজে জেন্ডার ও যৌন বৈচিত্র্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা চালু করা যেতে পারে। এতে ঘৃণা কমবে।

✅ ৪. ধর্মীয় আলেম ও সমাজবিজ্ঞানীদের সংলাপ প্রয়োজন

সমকামীদের অধিকার মানে ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া নয় — বরং একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া।


উপসংহার

সমকামিতাকে ঘৃণা করা খুব সহজ — কিন্তু সমকামীদের বাস্তব জীবন কল্পনা করে দেখেছেন কখনো?

  • সারাজীবন নিজের মতো করে ভালোবাসার অধিকার না থাকা,
  • পরিবারে নিজেকে লুকিয়ে থাকা,
  • সমাজে ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা,

এটা কি কোনো মানুষের প্রাপ্য?

আপনি সমকামিতাকে সমর্থন না করতেই পারেন — কিন্তু তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও ন্যায্য থাকা আপনার মানবিক দায়িত্ব।

বাংলাদেশ বদলাবে তখনই,
যখন আমরা বলব — “আমি তোমার মতো ভাবি না, কিন্তু তোমার বেঁচে থাকার অধিকার আমি মানি।”