লিখেছেনঃরুমানা আখতার রুমকি, যুক্তরাজ্য

মহরম বা আশুরা এলেই আমি ফের ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের ছবিগুলো পর পর দেখতে পাই। কী ভয়ানক সিরিয়াল কিলিং! ইসলাম যে কোন ধর্ম নয়- একটি রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ সেকথা সুকৌশলে গোপন রাখা হয়। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জানে সেটা বামপন্থীদের লেখার মধ্য দিয়ে। ফলে বামপন্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসুত লেখাগুলো কেবল অমুসলিমদেরই নয়, মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণীকেও ভুল ম্যাসেজ দেয়। মুসলমানরা তখন তাদের ধর্ম নিয়ে গর্ব করতে শেখে। ইসলাম যে একটা সাম্রাজ্যবাদ সেটা তারা জানতে পারবে এই লেখাটি পড়লে। আমি নতুন কোন খনি খুড়ে এই লেখা তৈরি করিনি। প্রচলিত সমস্ত ইসলামী সোর্স থেকে তুলে আনা হয়েছে তথ্যগুলো।

হযরত হাসান ইবন আলী যিনি ইমাম হাসান নামে মুসলিমদের কাছে সমাদৃত, যাকে বেহেস্তে যুবকদের নেতা নির্বাচন করে গেছেন নবী মুহাম্মদ, তার জীবন ও চরিত্র জানা এ অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলাম একটি সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করেছিল যার প্রসাদ চক্রান্তের বলি হয়েছিলেন হযরত আলীর জেষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান ও কনিষ্ঠ পুত্র ইমাম হোসেন। আরো একটি দিক হচ্ছে, রক্ত-মাংসের এই চরিত্রগুলো ধর্মের অলৌকিক দাবীর সঙ্গে মূর্তিমান কৌতুক যেন! যেমন নবী মুহাম্মদ তার দুই নাতির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন এভাবে, ‘হে আল্লাহ, এ দুজনকে আপনি দোয়া করুন, কারণ আমি তাদের জন্য দুয়া করেছি…’ (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৫)।

ইমাম হাসান বিষক্রিয়ায় ও ইমাম হোসেন কারবালায় খুন হয়েছিলেন। ইমাম হাসানের মৃত্যুটি ছিল করুণ ও অমর্যদাকর। বেহেস্তের যুবকদের নেতার এরকম হীন মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। তাদের নবী সম্মান চেয়েছিলেন, কল্যাণ চেয়েছিলেন আল্লাহ’র কাছে। নবীর সে দোয়ায় কোন কাজ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, ইমাম হাসানের মৃত্যু থেকে কোন রূপ শিক্ষণীয় নেই তার ভক্তবৃন্দর। বরং তার ভোগ-বিলাসময় জীবন আর দুঃশ্চিত্রতা ইসলামের জন্য হয়ে উঠেছে চরম বিব্রতকর।

নবী দৌহিত্র হিসেবে যথেষ্ঠ সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন হাসান। যদিও ব্যক্তি হিসেবে যথেষ্ঠ দুর্নাম ছিল তার। আবু হুরাইয়া একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নবী আপনার শরীরের কোন অংশে চুম্বন করেছিলেন? হাসান সে স্থান দেখালে আবু হুরাইয়া হাসানের নাভির কাছে চুম্বন করেন। এই হাদিসটি বর্ণনা করেন ইমাম আহমদ (র)। হাসানের পিতা আলীর সঙ্গে আবু বকর, ওমরের সম্পর্ক ভাল না থাকলেও তারা সকলে হাসানকে নবী দৌহিত্র হিসেবে সন্মান করতেন। হযরত ওমরের জমানায় হাসানকে ৫ হাজার দিরহাম মাসোহারা দেয়া হতো যা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা পেতেন। তবে মুআবিয়ার সময়ই হাসান পেতেন অঢেল অর্থ। ৪ লক্ষ দিরহাম তিনি ভাতা হিসেবে মুআবিয়ার নিকট গিয়ে নিয়ে আসতেন। এটি ছিল খিলাফতের দাবী ছেড়ে দেয়ার পুরস্কার। এই বিপুল অর্থে হাসান ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন সকাল-সন্ধ্যা। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রের এ অর্থ আসত জিজিয়া আর গণিমতের মালের মাধ্যমে। যে অর্থে লেগে থাকত লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর দীর্ঘশ্বাস।

ইমাম হাসানের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল নারী। তিনি সব সময় নতুন চারজন স্ত্রী নিয়ে চলতে ভালবাসতেন। তবে হাসান শত হলেও নবী মুহাম্মদের নাতি। তিনি যদি বিবাহ বর্হিভূত সেক্স করেন সেটা ভাল শোনায় না। তাই চোরের উপর বাটপারি করে তিনি বিয়ে করে বাসরঘর কাটিয়েই পরদিন সেই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিতেন। তিনি সর্বাধিক একই দিনে দুজন স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। তবে তিনি দয়াবান ছিলেন। তালাক প্রাপ্তাদের তিনি অর্থ ও মধু দিয়ে বিদায় করতেন। হযরত আলী তার পুত্রের এহেন চরিত্রের কারণে কুফার জনগণকে বলেছিলেন, তোমরা হাসানের কাছে তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ো না কারণ সে অতিশয় তালাক দানকারী ব্যক্তি…। রাতে বাসর ঘর করে পরদিন সকালে তালাক দিয়ে বের করে দেয়ার ব্যতিক্রমও হতো মাঝে মাঝে। একবার এরকম এক ‘একরাতের বউয়ের’ সঙ্গে রাত কাটানোর পর সকালে হাসান দেখে তার পায়ের সঙ্গে মহিলার ওড়না দিয়ে বাধা। হাসান তাকে জিজ্ঞেস করেন, কারণটি কি? তাদের বসর হয়েছিল খোলা ছাদের উপর। মহিলা ভয় পেয়েছিল হাসান যদি ঘুমের ঘোরে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যায়! দোষটা নিশ্চিত রূপেই তার উপরই আসবে। এ কারণেই সে সতর্কতা। হাসান শুনে তার প্রতি মহিলার প্রবল অনুরাগ মনে করে তাকে আরো সাতদিনের দাম্পত্য জীবনের সুখ দিয়েছিলেন বোনাস হিসেবে। অর্থ্যাৎ সাতদিন পরে তাকে তালাক দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল।

ভোগ বিলাস ও নারী লোলুপতার জন্য অঢেল অর্থের প্রয়োজন। আগেই বলেছি বিপুল পরিমাণ মাসোহারা পেতেন হাসান। কাজেই অর্থ চিন্তা তাকে করতে হতো না। নতুন নতুন নারীকে এক রাতের জন্য বউ বানানোর জন্য অঢেল ভাঙ্গতেও তাই কোন সমস্যা ছিল না। তার একটি বিয়ের বিবরণ পাওয়া যায় যেখানে নববধূকে একশ জন দাসী ও দাসীদের প্রতেক্যেক ১ হাজার করে দিরহাম বকশিস দিয়েছিলেন! এই অর্থ লোভে আরবের বহু লোভি বাবা-মাই এক রাতের জন্য হাসানের বউ হতে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হতেন। হাসান তার তালাক প্রাপ্তদের দশ হাজার দিরহাম ও এক বোতল মধু উপহার দিয়ে বিদায় করতেন। নিশ্চিত করেই অনেক লোভী পিতার চোখ চকচক করে উঠত এসব শুনে। তাছাড়া ফাও হিসেবে নবীর নাতির সেবায় মেয়েকে পাঠানোও তো কম সৌভাগ্যের কথা নয়…! সীরাত গ্রন্থকারদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে হাসানের এই চরিত্রকে ঢেকেঢুকে রাখতে। ইবনে কাসির, বুখারী ব্যাখ্যা করেছেন যে, হাসানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে লোকজন নবী বংশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে মড়িয়া ছিলেন বলেই বেচারা হাসানের অনিচ্ছা সত্ত্বে এতগুলো বিয়ে (ইবনে কাসিরের মতে সংখ্যাটা ৮০ উপরে! এছাড়া অগণিত দাসীবাঁদী তো ছিলেই আল্লার রহমতে!) করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বিশিষ্ঠ হাদিস ও সীরাত গ্রন্থকাররা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করেছিলেন। তারা ভুলে গিয়েছিলেন, তালাক দেয়ার পর ধর্মীয় মতেই আর কোন সম্পর্কই থাকে না স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কাজেই নবী বংশের সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবী আমড়া গাছে চড়ার মতই চেষ্টা। হাসানের এই বিয়ে বিয়ে খেলা যে নারীদের কতখানি ক্ষুব্ধ করেছিল সেটা সীরাত গ্রন্থগুলোতেই পাওয়া যায়। এরকমই একজন মারওয়ান যিনি হাসানকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন…। (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৩-৮৪)।

ইমাম হাসান ছিল অতিমাত্রায় লোভী, কাপুরুষ। তিনি যখন মুআবিয়ার সঙ্গে আপোষ করলেন তখন তার দলের লোকজন তাকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন ‘মুমিনদের গ্লাণি’! হাসান আপোষে খিলাফতের দাবী ছেড়ে দিয়েছিলেন এই শর্তে তিনি কুফার বাইতুল মালে (লুট করে কাফেরদের দেশ থেকে আনা রাজস্ব বা গণিমত) রক্ষিত সমস্ত অর্থ তিনি নিয়ে নিবেন। কুফার রাজকোষে তখন ৫০ লক্ষ দিরহাম ছিল! কল্পনা করুন সে যুগে সেটা কি পরিমাণ অর্থ ছিল! মুআবিয়া এহেন কাপুরুষের দাবী যে হাসতে হাসতে মেনে নিবেন সে তো বলাই বাহুল্য। ৫০ লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে গোটা খিলাফতের বাদশাহ হবেন- একমাত্র লোভী ছাড়া কে আর এই শর্ত দিতে পারে। এছাড়া বৎসরে ৪ লক্ষ দিরহাম দেয়ার অঙ্গিকারও করেন মুআবিয়া। হাসান যুদ্ধ পোশাক ছেড়ে বাড়ি এসে আমোদপ্রমোদের মেতে উঠেন। মুআইবয়া তার দেয়া কথা রেখেছিলেন। আমৃত্যু হাসানকে তিনি তার দাবী মত অর্থ দিয়ে এসেছেন। (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৩-৯৪)।

বহু নারী হাসানের গৃহে এসেছে, হাসান বহু বিবাহ করা পুরুষ ছিলেন। অনেকেই তাকে মনে মনে ঘৃণা করতেন। তাকে একাধিকবার বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বলে সীরাত গ্র্ন্থ দাবী করে। শেষবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। জা’দা বিনতে আশ’আছ নামের হাসানের একজন স্ত্রী হাসানকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে। কথিত আছে মুআবিয়া জা’দাকে হাসানকে হত্যার বিনিময়ে বিপুল অর্থ-সম্পদ ও খোদ খলিফা পুত্র ইয়াজিতের সঙ্গে বিয়ের অঙ্গিকার করেছিলেন। মুআবিয়া ছিলেন স্বয়ং নবী মুহাম্মদের উপদেষ্টা। এখানে ‘ইহুদীদের কোন ষড়যন্ত্র’ ছিল না। একইভাবে খলিফা ওসমানকে যারা হত্যা করেছিল তারা গৃহবন্দি ওসমানের ঘরের চারপাশে তাকে অবরুদ্ধ করে তাকবিরের সঙ্গে নামাজ আদায় করত। ওসমানের বুকে তলোয়ার চালানোর সময় তাদের মুখে ছিল ‘আল্লাহো আকবর’ শ্লোগান। একইভাবে ওমর ও আলীকে খুন করেছিল নামাজি আল্লাওয়ালা লোকজনই। এই দিকগুলো স্মরণে রাখা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

হাসানকে পানীয়র সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। হাসানের চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, বিষে হাসানের পেটের নাড়ি-ভূড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অকল্পনীয় যন্ত্রণায় হাসান মাত্র ৪৭ বছর বয়েসে মারা গিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক, বেহেস্তের যুবকদের নেতার এহেন করুণ পরিণতির মুজেজাটা কি? কিংবা হাসানের মৃত্যুর মোড়াল স্টোরিটাই বা কি? আজতক কোন ইসলামিস্টদের কাছে ইসলামের খিলাফত যুগে ঘটা একের পর এক খুনোখুনির মানেটা কি- জিজ্ঞেস করেও কোন যৌক্তিক উত্তরটি পাইনি। প্রকৃত উত্তরটা হচ্ছে, ইসলাম একদিন আরবের বুকে যে ভ্রাত্বি হত্যার আগুন জ্বালিয়েছিল, পিতার বিরুদ্ধে পুত্রকে লেলিয়ে দিয়েছিল, খিলাফতের জন্য যে রক্তের হোলিখেলা শুরু হয়েছিল, সেটাই ফাঙ্কাংস্টাইন হয়ে নিজেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। এর একটাই শিক্ষা হতে পারে- ঘৃণা দিয়ে কোন পরিবর্তন সাধিত হলে তার ফল দেরীতে হলেও খারাপই হবে। আজো ইসলামী বিশ্ব যে পরস্পর ঘৃণা ও আত্মঘাতিতে মত্ত সেটা তাদের ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করছে মাত্র…।

‘পবিত্র আশুরা’ বা মহরম সন্নিকটে। এই দিন নবী নাতি ইমাম হোসাইনকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার কাটা মন্ডু বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে আনন্দ উল্লাস করা হয়েছিলো। এই দিনকে তাহলে মুসলমানরা ‘পবিত্র’ বলছে কেন? আসলে একমাত্র শিয়ারা ছাড়া আশুরা পালন করা অন্য মুসলমানদের জন্য রীতিমত অস্বস্তিকর! কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে যাবার মত অবস্থা। এ কারণে ইদানিং আশুরা পালন নিয়ে মুসলমানদের সুন্নি গ্রুপ রীতিমত বিদ্রোহ প্রকাশ করছে। তারা বলছে আশুরার দিন নবী রোজা রাখতেন, সে হিসেবে আশুরা পবিত্র। প্রকৃতপক্ষে মহরম মাসের এই দশ তারিখে মদিনার ইহুদীরা রোজা রাখত, সেটি দেখাদেখি মদিনা যাবার পর মুহাম্মদও একই দিন রোজা রাখা শুরু করে। তার মৃত্যুর পর প্রায় ষাট বছর পরে এই মহরম মাসের দশ তারিখেই কারবালা নামক স্থানে হোসাইনকে হত্যা করে খলিফা ইয়াজিদ বাহিনী। হোসাইনের অনুসারীদের কাছে সেই থেকে মহরম মাসের দশ তারিখ অত্যন্ত বেদনাদায়ক। প্রকৃত পক্ষে এই দিনটি আসলে ইসলামের আসল চেহারা প্রকাশিত হয়ে যাবার একটি অন্যতম ঐতিহাসিক দিন। হযরত মুহাম্মদ ইসলামী শাসন নামের যে খিলাফত সৃষ্টি করেছিলেন সেটি কতখানি বিষবৃক্ষ ছিলো তার অন্যতম ঘটনা ছিলো কারবালার হত্যাকান্ড। তারও আগে হযরত আলীর হত্যাকান্ডের কথাটা স্মরণ করুন। আলী সেজদা দেওয়া অবস্থায় তাকে হত্যা করেন আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম। এই লোক পাক্কা ঈমানদার একজন মুসলমান। কিন্তু খেলাফতের রাজনীতিতে আলীকে হত্যা করতে তার হাত কাঁপেনি। একইভাবে হযরত উমার ও ওসমান খুন হয়েছিলো অপর মুসলমানের হাতে ক্ষমতার রাজনীতিতে। ইসলাম যদি পৃথিবীতে রহমত হিসেবে এসে থাকে তাহলে এই তিনজন কেন অপঘাতে নির্মমভাবে মারা যাবে?

এবার আসি নবীর দুই নাতি প্রসঙ্গে। ইসলাম তো কেবল নামাজকলাম পড়ার ধর্ম না, ইসলাম হচ্ছে ক্ষমতা ও রাজনীতির ধর্মও। এই ক্ষমতার ভাগ চাইতে গিয়ে, সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবী করতে গিয়ে নবী কন্যা ফাতিমা উমারের চাকরের হাতে আঘাত পেয়ে গর্ভপাত হয়ে মারা যান। হযরত আবু বকরের পুত্রকে বস্তায় ভরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। যারা এই হত্যাগুলো করেছে তারা সবাই নামাজী আল্লাঅলা মুসল্লি মুসলমান ছিলো। ইমাম হোসাইনের মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিলো বড় বড় সব মুসলমানরা। (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৫)।

কারবালায় মহরম মাসের দশ তারিখে ইমাম হোসেইনের মাথা কেটে আসরের নামাজ আদায় করেন মুসলিম জাহানের খলিফা ইয়াজিদের বাহিনী। হোসেনের কাটা মাথা ধুলোয় মাখামাখি। ইয়াজিদ বাহিনী সেই কাটা মন্ডু বর্শার মাথায় গেঁথে আনন্দ উল্লাস করতে করতে ইয়াজিদের দরবারে পেশ করে। এই ছিন্ন মস্তকই ইসলাম নামের বিষবৃক্ষের একটি ফল। ভাবা যায় নবীর কনিষ্ঠ ও প্রিয় স্ত্রী হযরত আয়েশার কপালেও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো না। সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী নারীর কেন অপঘাতে মৃত্যু হবে? হযরত আয়েশাকে গর্ত করে ফাঁদ বানিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন প্রফেট মুহাম্মদের রাজনৈতিক সচিব ও পরে খলিফা মুয়াবিয়া (ইসলামের ইতিহাস, মাওলানা আকবর শাহ নাজিরাবাদী ২য় খন্ড পৃ ৪০, ইসলামিক ফাউন্ডশন বাংলাদেশ)

আয়েশার ভাইকেও নির্মমভাবে বস্তায় ভরে হত্যা করা হয়েছিলো মুয়াবিয়ার নির্দেশে। আয়েশার ভাগ্নে যুবায়েরকে হত্যা করে সাতদিন পর্যন্ত কাবার সামনে লটকিয়ে রাখা হয় তার লাশ। হযরত ফাতিমা ওমরের চাকরের হাতে আঘাত পেয়ে গর্ভপাতে মৃত্যু হয়। মুহাম্মদ খয়বার যে বিষযুক্ত মাংস খেয়েছিলেন সেই বিষক্রীয়ায় মারা যান (বুখারীঃ ৪০৯৪),  সেকথাও বলা যায়…।

হযরত ফাতেমার মৃত্যু নিয়ে আলেমদের লুকোচুরি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছিলো ডালমে কুচ কালা হ্যায়…। কেঁচো খুড়তে গিয়ে দেখি সাপ বেরিয়ে এলো! কি মর্মান্তিক, হযরত ফাতিমার গর্ভপাতে মৃত্যু ঘটেছিলো! তবে সন্তান ভুমিষ্ঠ হতে গিয়ে নয়, হযরত উমার ও হযরত আবু বককের মিলিত আক্রমনে ফাতেমা মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গর্ভপাতের সৃষ্টি হয়। সরাসরি হাদিস থেকে পড়ুন- মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারি (মৃ: চতূর্থ হিজরি) বর্ণনা করেন:

[عَن أبِیبَصِیرٍ عَن أبِی عَبدِاللهِعلیهالسّلام: قالَ:]

وَ کانَ سَبَبُ وَفاتِها أنَّ قُنفُذاً مَولی عُمَرَ لَکَزَها بِنَعلِ السَیفِ بِأمرِهِ، فَأسـقَطَت مُحسِناً وَ مَرِضَت مِن ذلِکَ مَرَضاً شَدِیداً…

ইমাম আবু আব্দিল্লাহের কাছ থেকে আবু বাছির বর্ণনা করেছেন : ওমরের নির্দেশে তার ভৃত্য ‘কুনফুয’ তরবারির গিলাফ দিয়ে ফাতেমাকে আঘাত করেছিলো, যে কারণে মুহসিনের গর্ভপাত ঘটে এবং সে কারণেই ফাতেমা আ. মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন… (দালায়েল উল ইমামাহ/৪৫)।

বিষয়টা কিন্তু সুন্নি আলেমরা এড়িয়ে যান। ফাতেমার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিলো এই বিষয়ে তাদের মুখে কোন রা নেই। নবীর মৃত্যুর মাত্র তিন মাসের মধ্যে ফাতেমার কি এমন হলো যে এত অল্প বয়েসে মারা গেলেন? তাবারসি বর্ণনা করেছেন এভাবে-

وَ حالَت فاطِمَةُعلیهاالسّلام بَـینَ زَوجِها وَ بَـینَهُم عِندَ بابِ البَیتِ فَضَرَبَها قُنفُذٌ بِالسَوطِ عَلی عَضُدِها، فَبَـقِیَ أثَرُهُ فِی عَضُدِها مِن ذلِکَ مِثلَ الدُملُوجِ مِن ضَربِ قُنفُذٍ إیّاها فَأرسَلَ أبوبَکرٍ إلی قُنفُذٍ إضرِبها، فَألجَـأها إلی عِضادَةِ بَـیتـِها، فَدَفَعَها فَکَسَرَ ضِلعاً مِن جَنبِها وَ ألقَت جَنِیناً مِن بَطنِها، فَلَم تَزَل صاحِبَةَ فِراشٍ حَتّی ماتَت مِن ذلِکَ شَهِیدَه …

হযরত ফাতেমা তাঁর স্বামি ও আক্রমনকারী ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেছিলেন, তখন ‘কুনফুয’ ফাতেমার উরুতে এমন আঘাত হানল যে, তার দাগ বেন্ডেজের আকার ধারণ করল। আবুবকর কুনফুযকে ফাতেমাকে মারার জন্য পাঠিয়েছিল! তাই কুনফুয ফাতেমাকে ঘর থেকে আছার দিয়ে ফেলে দিল, তখন তাঁর উরুর হাড় ভেঙ্গে গেল ও পেটের সন্তানের গর্ভপাত ঘট।অতঃপর দীর্ঘ শয্যাশায়ী হল এবং সে অবস্থাতেই শহীদি মৃত্যু বরণ করলেন …(এহতেজাজ, ১/৮৩)।

হায় হায়, জান্নাতের মহিলাদের সর্দার্নী ফাতেমা তুজ জোহরা কেন এমনভাবে অপঘাতে মারা যাবেন? আর তার মৃত্যুর জন্য দায়ী উমার ও আবু বকর! কি এমন ঘটেছিলো যে আলীকে হত্যা করতে আবু বকর উমারকে পাঠিয়েছিলেন দলবল নিয়ে? কারণ গোপন খবর ছিলো আলীর ঘরে খিলাফতের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে। সেই সংবাদ পেয়ে হামলা চালানো হয় আলীর বাড়িতে। ফাতেমা স্বামী আর শত্রুদের মাঝখানে পড়ে মারাত্মক আঘাত পান। নিতান্তই ক্ষমতা নিয়ে এই ঝগড়া মারামারি কেন সৃষ্টি হয়েছিলো। ইসলামের যদি উদ্দেশ্য থাকে সত্য ধর্ম প্রচার করার তাহলে তার মধ্যে মসনদ বা সিংহাসন এসে যায় কিভাবে? ইসলাম যে সাম্রাজ্যবাদী একটা ধর্ম তার কিছু প্রমাণ এক্ষুণি দিবো। কেমন করে গদির নেশায় পুরো নবী বংশ একের পর এক অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিলো। শুরুটা হয়েছিলো খোদ নবী মুহাম্মদকে দিয়ে। ইহুদীদের উপর চালানো গণহত্যা, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, তাদের পুরুষদের হত্যা ও নারীদের গণিমতের মাল করে যৌনদাসী হতে বাধ্য করার প্রতিশোধ নিতে একজন ইহুদী বৃদ্ধা নবীকে বিষ খাইয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে। তার দুই পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিষ মাখানো বকরির মাংস খেতে দেন মুহাম্মদ ও তার দুই সঙ্গীকে। খয়বর দখল করার পর বিষ মাখানো মাংস পরিবেশন করা হয়। মাংস মুখে দিয়েই মুহাম্মদের দুই সঙ্গী ঢলে পড়লেও মুহাম্মদ মাংস গেলার আগেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরে মুখ থেকে মাংস ফেলে দেন। ইহুদী বুড়িকে ডেকে এনে জেরা করার পর সে স্বীকার করে বিষ মাখানোর কথা। মুহাম্মদের পেটে পর্যাপ্ত বিষ না গেলেও সেই বিষের যে পরিমাণ অংশই গিয়েছিলো তাতে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। খয়বরের এই ঘটনার পর থেকে মুহাম্মদ অসুস্থ হতে থাকেন। জ্বর ও শরীর দুর্বল হতে থাকে। মৃত্যুর সময় মুহাম্মদ তীব্র মাথার যন্ত্রণায় সহ্য করতে না পেরে আয়েশাকে বলেছিলেন, হে আয়েশা, আমার মাথার মধ্যে যেন সব ছিড়ে যাচ্ছে… খয়বরে যে বিষ মাখানো মাংস খাওয়ার জন্যই যে তিনি অসুস্থ সেটা আয়েশাকে বলে গিয়েছিলেন। মুহাম্মদের প্রিয় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসাউদ বলেছিলেন, ‘আমি দরকার হলে ৯ বার কসম খেয়ে বলতে পারব, রাসুল (স)-কে হত্যা করা হয়েছে, কারণ আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে নবী করেছেন, আর করেছেন শহীদ’। (দেখুন: সহি বুখারী, খন্ড-৭, অধ্যায়-৭১, হাদিস- ৬৬৯, যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৯, ফতহুল বারী, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭ ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৭ )।

নবীর এই মৃত্যুর পর ফাতেমার গর্ভপাতে মৃত্যু। এরপর আলীর খুন হন মসজিদে। আলী সেজদা দেওয়া অবস্থায় তাকে হত্যা করেন আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম। এই আবদুর রহমানও একজন আল্লাঅলা পাক্কা মুমিন মুসলমান। এখানে ইহুদীনাসারাদের কোন কারবার নেই। গোটা নবী বংশ হত্যা করেছে নামাজী পাক্কা ঈমানদার মুসলমান। আলীর মৃত্যু হয় জানুয়ারি ২৬, ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ। বিস্তারিত দেখুন-: https://en.wikipedia.org/wiki/Assassination_of_Ali#Death

নবী বংশের অপমৃত্যু কিন্তু এরপরেও থেমে থাকেনি। হুসাইনের ছেলে জইনুল আবেদীনকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। তার ছেলে আল বাকিরকেও বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয় ৭৩৩ সালে। বাকির ছেলে জাফর সাদিক, তার ছেলে মুসা আল কাজিম, কাজিমের ছেলে আর রিযা- এদেরকেও বিষয় প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর আরো তিন-চার প্রজন্ম নবী বংশের ইমামদের বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এর কারণ কি? এই অভিশপ্ত বিষ প্রয়োগের ধারাবাহিকতা শানে নাযুলটা কি? ইসলাম নামের যে বিষবৃক্ষটার জন্ম দিয়েছিলেন নবীজি- একি তারই প্রায়শ্চিত্ত? মক্কা-মদিনার অসংখ্যা মায়ের কোল খালি করার যে খেলা ইসলাম শুরু করেছিল একি তারই সচেতন প্রতিশোধ ছিল?